বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষাভাবনার উপর এটাই সম্ভবত প্রথম বই। এই মহান রাষ্ট্রনায়ক স্বাধীনতার আগে থেকেই তাঁর স্বপ্নের নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’-এর শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে ভেবেছেন এবং বক্তৃতা-বিবৃতিতে তার কিছু উল্লেখও করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে স্বল্প সময় তিনি পেয়েছিলেন, সে সময়ের মধ্যে আর্থিক সংগতি সীমিত থাকলেও বঙ্গবন্ধু সবধরনের শিক্ষা নিয়ে ভেবেছিলেন এবং একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। শিক্ষাকে তিনি জাতীয়করণ করতে চেয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক যুগোপযোগী শিক্ষা। বঙ্গবন্ধুর সেসব চিন্তাভাবনা দেশের সেরা শিক্ষাবিদগণ তুলে ধরেছেন তাঁদের নিজস্ব বিশ্লেষণে এই গ্রন্থের প্রবন্ধাবলিতে।
বইটি পাঠ করলে, একনজরে বোঝা যাবে, বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন কী ছিল এবং কোনপথে আমাদের আজ অগ্রবর্তী হতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সবার জন্য বইটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। সেইসাথে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাঁর কর্ম ও চিন্তা নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে, তাদের জন্যও এই বই পাঠ জরুরি বলে মনে করি।
এই গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আবদুল খালেকের লেখা ‘বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা : গতি-প্রকৃতি’। অধ্যাপক আবদুল খালেক দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা-গবেষণা নিয়ে ভাবছেন। এই প্রবন্ধে তিনি মূলত বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা ও রাজনৈতিকভাবনার যোগসূত্র চিহ্নিত করে এর গতি-প্রকৃতি নির্দিষ্ট করেছেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, স্বাধীনোত্তকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-অসন্তোষ নিরসনে বঙ্গবন্ধু কীভাবে সশরীরে ক্যাম্পাসে আগমন করেছিলেন এবং শিক্ষা ও পরীক্ষার ধারা সমুন্নত রেখেছিলেন। এতেও প্রকাশ পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাচিন্তা। অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ শিক্ষা-কমিশন ২০১০-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তিনি তাঁর ‘বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন, কারিগরিশিক্ষা ও বাস্তবতা’ শিরোনামের প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনার পাশাপাশি তিনি কারিগরিশিক্ষা নিয়ে কী ভেবেছেন ও করেছেন এবং সে-সূত্রে এখন কী করা হচ্ছে তার একটি সাম্প্রতিক রূপরেখা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য শিক্ষাবিদ প্রফেসর আবদুল মান্নান তাঁর প্রবন্ধে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ ও পদক্ষেপের বিবরণ তুলে ধরে লিখেছেন, তাঁর অকাল প্রয়াণ না হলে আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির কতটুকু বিকাশ হতো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রো-উপাচার্য প্রফেসর হারুন-অর-রশিদ তাঁর প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা তো তুলে ধরেইছেন, পাশাপাশি বর্তমানে সে নিরিখে কতটুকু অর্জন সাধিত হয়েছে, তার বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) প্রফেসর এ এস এম মাকসুদ কামাল তাঁর প্রবন্ধ ‘মৌলভি সাখাওয়াত উল্লাহ ও বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন’-এ জ্যেষ্ঠসহোদরের একটি অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর শিক্ষককে কোন চোখে দেখতেন এবং শিক্ষার জন্য কী করেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা নূহ-উল-আলম লেনিন তাঁর প্রবন্ধ ‘বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন’-এ ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাভাবনাকে ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের শিক্ষানীতি। বর্তমান গ্রন্থের সম্পাদকের প্রবন্ধ ‘বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাচিন্তা’ রচিত ও একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এই শতাব্দীর সূচনাতে, যখন এতদ্বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ তেমন ছিল না বললেই চলে। সেটি এখানে সংস্করণ করে হাল-আমলের অভিজ্ঞতার মিশেল দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাচিন্তার আলোক কীভাবে ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতেও প্রতিফলিত হয়েছে, তার উল্লেখ আছে সে প্রবন্ধে। গাজিপুরস্থ ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রফেসর মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুর গবেষণাপ্রিয়তা ও সে দিকে তাঁর আগ্রহের দিকটি তুলে ধরেছেন। তাঁর বক্তব্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল সফল রাজনীতিবিদ ছিলেন না; বরং বহুমাত্রিক নতুন ধারণা উদ্ভাবনের মাধ্যমে সর্বজনীন দর্শন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূলশক্তিও ছিলেন- যার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। প্রাবন্ধিক মুহম্মদ মুনিরুল হক শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে তার নিরিখে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা উল্লেখ করেছেন। ড. মাহবুব লিটু ও আরিফুর রহমান যৌথভাবে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাচিন্তা কীভাবে জাতির জন্য জ্ঞানীয় সম্পদ হলো এবং কীভাবে তা বাঙালির লালন করা প্রয়োজন। কবি ফারুক নেওয়াজ তাঁর প্রবন্ধে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তথ্যভাণ্ডারী অনুপম হায়াৎ বঙ্গবন্ধুর শিক্ষকদের নাম ও পরিচয় অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সংযোগ কীভাবে, সেই অনুসন্ধানটি করেছেন। প্রাবন্ধিক মুতাসিম বিল্লাহ আরও একটু বাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনের সংযোগসূত্র চিহ্নিত করেছেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তার উল্লেখ ও বিশ্লেষণ করেছেন প্রাবন্ধিক ফারুক আহমেদ আরিফ। প্রাবন্ধিক শাহাব উদ্দিন মাহমুদ তাঁর প্রবন্ধে ব্যক্ত করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার। আর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনার আলোকে শিক্ষার অগ্রযাত্রা আরও কীভাবে বেগবান হতে পারে, সে অনুসন্ধান ব্যক্ত হয়েছে প্রাবন্ধিক আরিফুর সবুজের প্রবন্ধে। মোটকথা, সংকলিত প্রবন্ধসমূহে যে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান পাওয়া যায়, তাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষাভাবনার রূপরেখাটি স্পষ্টতই মেলে।